একদল ঐতিহাসিক মনে করেন যে, বিপ্লবের আগে মন্তেস্কু, ভলতেয়ার, রুশো, ভেনিস দিদেরো, ডি এলেম্বার্ট সহ বিভিন্ন দার্শনিক তাঁদের রচনার মাধ্যমে ফ্রান্সের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ত্রুটিবিচ্যুতিগুলি সাধারণ মানুষের চোখ খুলে দেয়ার ফ্রান্সে বিপ্লব। আবার অন একদল ঐতিহাসিক ফরাসী বিপ্লব সংঘটনের পিছনে দার্শনিকদের ভূমিকা খুব বেশি গুরুত্ব দেননি।
দার্শনিকদের ভূমিকার সপক্ষে যুক্তি
ঐতিহাসিক টেইন, রুস্তান, রাইকার, সেতোব্রিয়া, মাদেলা , জোরেস, মতিয়া, লাব্রুজ প্রমুখ মনে করেন যে, ফরাসী বিপ্লব ঘটার পিছনে দার্শনিকদের গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা ছিল। এই ঐতিহাসিকদের যুক্তিগুলি হল –
(1) জনগনের সচেতনতা: কোনো সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার বৈষম্য থাকলেই তার বিরুদ্ধে জনগণ বিপ্লব শুরু করে না। এই ত্রুটিবিচ্যুতিগুলির বিরুদ্ধে জনগণ সচেতন হলেই তার বিরুদ্ধে বিপ্লব হতে পারে। ফ্রান্সের দার্শনিকগন জনগনকে সচেতন করার কাজটি করেছিলেন।
(2) দার্শনিকদের জনপ্রিয়তা: অষ্টাদশ শতকে ফ্রান্সে বিভিন্ন দার্শনিকের মতবাদ খুবই জনপ্রিয় ছিল। প্যারিসের চায়ের দোকান ও ক্লাবগুলিতেও দার্শনিকদের মতামত সারা দেশের জনগনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ত।
(3) দার্শনিকদের মৌলিক চিন্তা: দার্শনিকরা সকলেই মৌলিক চিতার অধিকারী বলে তাঁদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকা স্বাভাবিক। এই মতপার্থক্য সত্ত্বেও সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অন্যায়-অবিচার সম্পর্কে দার্শনিকরা সকলেই একমত ছিলেন।
দার্শনিকদের ভূমিকার বিপক্ষে যুক্তি
লেফেভর, মনিয়র, মর্স স্টিফেন্স, ম্যালো-দ্যা-পান প্রমুখ ঐতিহাসিক বিপ্লবের জন্য দার্শনিকদের ভূমিকায় বিপক্ষে নিম্নলিখিত যুক্তি দিয়েছেন-
(1) প্রতক্ষ্য যোগের অভাব: দার্শনিকরা ফ্রান্সের পুরাতনতন্ত্র ও সমাজব্যবস্থার ভুলত্রুটির উল্লেখ করলেও তাঁরা প্রত্যেক্ষভাবে বিপ্লবের ডাক বা নেতৃত্য দেননি। অর্থাৎ বিপ্লবের সঙ্গে দার্শনিকদের প্রত্যেক্ষ যোগ ছিল না।
(2) পুরাতনতন্ত্র: ফ্রান্সের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় যে অসংখ্য দোষত্রুটি ছিল তার জন্যই সেখানে বিপ্লব হয়েছিল। এই বিপ্লবে দার্শনিকদের ভূমিকা ছিল খুবই সামান্য। মর্স স্টিফেল বলেছেন যে, “ফরাসী বিপ্লবের কারণ ছিল মূলত অর্থ্যনৈতিক ও রাজনৈতিক – দার্শনিক ও সামাজিক নয়।”
(3) দার্সনিকদের মতানৈক্য: ফ্রান্সের বিভিন্ন দার্শনিকদের মতের মধ্যে যথেষ্ট অমিল ছিল। মন্তেস্কু ছিলেন নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্তের সমর্থক। অন্যদিকে, রুশো ছিলেন প্রজাতন্ত্রের সমর্থক।
(4) নিরক্ষতা: বিপ্লবের আগে ফ্রান্সের বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ ছিল নিরক্ষর। তারা দার্শনিকদের রচনাবলী পড়ত না। তাই দার্শনিকদের মতবাদ ফ্রান্সের সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপভাবে ছড়িয়ে পরার সম্ভাবনা ছিল না।
মূল্যায়ন : ফরাসি বিপ্লবের পশ্চাতে দার্শনিকদের ভূমিকা সম্পর্কে ঐতিহাসিক ডেভিড টমসন বলেছেন যে, “বিপ্লব ঘটার পিছনে দার্শনিকদের প্রভাব ছিল ক্ষীন ও পরোক্ষ। তবে অধিকাংশ ঐতিহাসিক মনে করেন যে, :দার্শনিকগণ জনগনের মধ্যে বিপ্লবের যে বীজ বপন করেছিলেন তা উপযুক্ত জমিতে যথাসময়ে অংকুরিত হয়।” তায় বলা যায় যে, “বিপ্লব ছিল দর্শনের কন্যা।”